অমর কথাশিল্পী মানিক বন্দোপাধ্যায়ের জন্মবার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধা




‘সব মানুষের মধ্যে একটি খোকা থাকে যে মনের কবিত্ব, মনের কল্পনা, মনের সৃষ্টিছাড়া অবাস্তবতা, মনের পাগলামিকে লইয়া সময়ে-অসময়ে এমনিভাবে খেলা করিতে ভালোবাসে’- এমন কথার নিপুণ কারিগর ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র কুবের-কপিলার জীবন রসায়ন কিংবা ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র মানবকলার সূত্রবিন্যাসের অমর স্রষ্টা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। কথার জাদুকর মানিকের হয়েই যেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গানের পঙ্‌ক্তি সাজান, ‘হেলাফেলা সারা বেলা একি খেলা আপন সনে’। 

গণমানুষের যাপিত জীবনের কুশলী রূপকার কথাশিল্পী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ( মে ১৯, ১৯০৮-ডিসেম্বর ০৩, ১৯৫৬) ছিলেন এক বিশেষ ঘরানার সাহিত্যিক। জীবদ্দশায় ‘নির্জনতম’ কথাকারের আখ্যা পেলেও, তাঁর সমকালীন বুদ্ধদেব, জীবনানন্দ, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্তকুমার, বিষ্ণু দেসহ অনেক শ্রেষ্ঠ কবিই মানিককে গ্রহণ করেছিলেন সহৃদয়তায়। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো শক্তিমান কথাসাহিত্যিককেও নিজের শেষ জীবনের রোগভোগের কালে পাশে পেয়েছেন মানিক। বাংলা কবিতা ও কথাসাহিত্যের আধুনিকতায় উত্থানের কালে সাহিত্যাকাশের এমন সব তারার সমারোহেও মাত্র ৪৮ বছরের অল্প আয়ুষ্কালের মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যতিক্রমী কথাশিল্পী হিসেবে নিজের নামটি স্মরণীয় করে রেখেছেন। বলা হয়ে থাকে রবীন্দ্রোত্তরকালে তাঁর বলয় ছাড়িয়ে প্রান্তিক মানুষের বহির্জীবন ও অন্তর্জীবনের বিষয় বৈচিত্র্য, লড়াই ও এগিয়ে চলবার মন্ত্রণাকে যিনি সবচেয়ে’ সফলভবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন তিনি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।

কেমন চরিত্রের ছিলেন এই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়? জীবনযোদ্ধা মানিক ২৬ বছর বয়সে নিতান্ত জীবিকার প্রয়োজনে তৎকালীন ‘বঙ্গশ্রী’ পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক পদের জন্য একটি আবেদনপত্র পাঠিয়েছিলেন। সেই পত্রে সাতটি ছত্রে তিনি তাঁর গুণপনার কথা উল্লেখপূর্বক শেষ অনুচ্ছেদটি লিখেছিলেন এভাবে- ‘পরিশেষে নিবেদন এই, আমি অবগত আছি শ্রী পরিমল গোস্বামী এই পদটির জন্য আবেদন করিবেন। আমার চেয়েও তাঁহার চাকুরির প্রয়োজন বেশি। মহাশয় যদি ইতিমধ্যে তাঁহার সম্বন্ধে অনুকূল বিবেচনা করিয়া থাকেন তবে অনুগ্রহপূর্বক আমার এই আবেদন প্রত্যাহার করা হইল বলিয়া ধরিয়া লইবেন। কারণ, শ্রী পরিমল গোস্বামী মহাশয়ের সহিত আমি প্রতিযোগিতা করিতে ইচ্ছুক নহি।’

চল্লিশের দশকে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘে’ যুক্ত হওয়া আপাদমস্তক কমিউনিজমে বিশ্বাসী সেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কলেজে বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে জীবনের প্রথম গল্প ‘অতসীমামী’ লিখে ফেলেন। তারপর আর পেছন ফিরে তাকাননি স্নাতক শ্রেণি থেকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ড্রপ আউট মানিক। ১৯৩৪ সালে ‘বঙ্গশ্রী’ সাহিত্য পত্রিকায় ‘দিবারাত্রীর কাব্য’ উপন্যাসটির ধারাবাহিক প্রকাশের মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিক হিসেবে তাঁর যাত্রা শুরু হয়। পরের বছর ‘পূর্ব্বাশা’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসটি। ১৯৩৫ সালে ‘জননী’, ‘দিবারাত্রীর কাব্য’ উপন্যাস এবং ‘অতসীমামী ও অন্যান্য গল্প’ গল্পগ্রন্থ প্রকাশের মধ্য দিয়ে তাঁর গ্রন্থকার হিসেবে যাত্রা শুরু হয়। এভাবে কেবল লেখালেখিকে পেশা হিসেবে নিয়ে সামান্য উপার্জনের মাধ্যমে সংসারের হাল ধরার আশায় একে একে লিখে গেছেন ৪০টি উপন্যাস, ৩০০টিরও অধিক ছোটগল্প আর বিপুল প্রবন্ধ।

তবে সাব-ডেপুটি কালেক্টর পিতা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্র হয়েও জীবনবাদী লেখক প্রবোধকুমার তথা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যক্তিজীবনে অভাব মেটেনি কোনোদিন। ক্ষুরধার লেখক মানিককে একসময় লুম্বিনি পার্ক মানসিক হাসপাতালে পর্যন্ত যেতে হয়েছিল। শেষাবধি মৃত্যুবরণ করতে হয় শোচনীয় দারিদ্র্যের মধ্যে।

কিন্তু দরিদ্রতার ভয়াল কষাঘাত সত্ত্বেও দিবারাত্রি পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কথকতায় মানুষের জীবনের গল্প বুননের এক অনন্যসাধারণ দক্ষতা এমনভাবে অর্জন করেছিলেন, যা কেবল অসাধারণ বিস্ময়কর প্রতিভাবানের পক্ষেই সম্ভব। হয়তো নিয়তির প্রবল ইচ্ছে এই ছিল যে, নিজে দারিদ্র্যজাত হয়েই লেখা আর গল্পবুনায় প্রান্তজনের সখা হয়ে উঠবেন মানিক।

সেকালের আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতি আর দেশজ স্বাধীনতা সংগ্রামের কালে নিজেকে গল্পকার হিসেবে বিনির্মাণ করতে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের উপযুক্ত ব্যবহারে পারঙ্গম হয়ে উঠেছিলেন মানিক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বজুড়ে মানবিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় কিংবা একদম বোধহীনতার কালে ফ্রয়েডিয় মনঃসমীক্ষণ ও মার্কসীয় শ্রেণিসংগ্রাম তত্ত্বে প্রভাবিত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম ও নিয়তিবাদকে লেখার মূল বিষয়বস্তু হিসেবে গ্রহণ করে বাংলা কথা-সাহিত্যে এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত করেন। মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, কডওয়েলের রচনা মানিক বন্দ্যোপধ্যায় নিষ্ঠার সঙ্গে পাঠ করেছিলেন। 

তবে জীবনের প্রথমভাগের ফ্রয়েড বা মার্কসীয় ভাবনাকে পেছনে ফেলে নিজস্ব চিন্তাচেতনাপ্রসূত মনুষ্যত্ব ও মানবতাবাদের জয়গানই হয়ে ওঠে তাঁর সাহিত্যের মূল উপজীব্য। তাই তো তিনি পদ্মা নদীর মাঝিতে মানবসত্যকেই তুলে ধরেন গল্পকথার বর্ণনায়, ‘কী ক্ষতি মুসলমানের রান্না খাইলে? ডাঙার গ্রামে যারা মাটি ছানিয়া জীবিকা অর্জন করে তাহাদের ধর্মের পার্থক্য থাকে, পদ্মা নদীর মাঝিরা সকলে একধর্মী।’

পদ্মা নদীর মাঝির কেন্দ্রীয় চরিত্ররা সবাই পদ্মাতীরের মাঝি, জেলে-ধীবর ও অন্যান্য নিম্নবর্ণের সম্প্রদায়ভুক্ত। আখ্যানের সব ঘটনাই তাদের জীবন-নির্ভর। কুবের, কপিলা, মালা, রাসু, আমিনুদ্দী নিম্নবর্গীয় সবাই এই জীবননাট্যের প্রান্তিক কুশীলব। মানিক সচেতনভাবে উপন্যাসে নিম্নশ্রেণীর মানুষের জীবনবোধ ও জীবনসংগ্রামকে উপজীব্য করেছেন। এই উপন্যাসে জেলেপাড়ার হতদরিদ্র মানুষের ওপর সমাজের তথাকথিত 'ভদ্র'দের নিপীড়নের চিত্র আঁকতে গিয়ে বলেছিলেন, 'ঈশ্বর থাকেন ওই গ্রামে, ভদ্রপল্লীতে। এখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।’ এভাবে সর্বকালের মানবীয় শ্রেণিবৈষম্যের সত্যিকারের স্বরূপটাই যেন উদ্ভাসিত হয় মানিকের গল্পকথার নিপুণ কলমে। বলা যায়, মানিকের লেখালেখির কালে জমিদারপ্রথার ছুৎমার্গ আর ব্রিটিশ বেণিয়াদের ভয়ঙ্কর ঔপনিবেশিকতার যাতাকলে পিষ্ট অচ্ছুত নিম্নবর্গের মানুষকে নিজের আখ্যানকাব্যের নায়ক-নায়িকা করে মানুষের জয়গান করাটা মানিকের একক কৃতিত্ব।

বাংলা উপন্যাসের সূচনালগ্নে প্যারীচাঁদ মিত্র, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এমনকি সব্যসাচী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাসেও নিম্নবর্গের যথোচিত উন্মোচন দেখা যায়। সেখানে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সমসাময়িক তুখোড় লেখকদের প্রভাবমুক্ত হয়ে নিজের চিন্তা ও কল্পনার গভীরতা দিয়ে উপেক্ষিত বা অনার্যের সংস্কৃতি, ঘর গৃহস্থালী আর জীবনকথার অন্তরালকেই নিজের হৃদয়গত বুদ্ধিবৃত্তি আর সুক্ষ্ম অনুসন্ধান দিয়ে রূপায়ণ করে গেছেন। এমন করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের ভাঙ্গা-গড়ার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবকে তিনি তাঁর সাহিত্যে যেমন চিত্রায়িত করেছেন, তেমনি সমাজের শাসক ও পুঁজিপতিদের হাতে দরিদ্র সমাজের শোষণবঞ্চনার স্বরূপও তুলে ধরেছেন সাহিত্যের নানান চরিত্রকে মাধ্যম করে। আর এভাবেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে উঠেছেন অবহেলিত প্রান্তিকজনের সাহিত্যসখা।  

‘লেখক হচ্ছে কলম-পেষা মজুর’, মনে করতেন মানিক। জীবনানন্দ দাশের মতো তিনিও মনে করতেন, ‘পৃথিবীতে নেই কোনো বিশুদ্ধ চাকরি।’ ওসব চাকরিবাকরি বা ব্যবসাবাণিজ্য কোনোদিনও মানিকের গা সওয়া হয়ে ওঠেনি।

রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালে মানিকের ১২টি বই প্রকাশিত হলেও একটিও তিনি পাঠাননি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মন্তব্যের জন্য। জীবনানন্দ দাশ, তিনিও রবীন্দ্রনাথকে কবিতাগ্রন্থ পাঠিয়ে তাঁর মতামতের জন্য কাতর অনুরোধ করেছেন; এমনকি রবীন্দ্রদ্রোহী বুদ্ধদেব বসু, তিনিও রবীন্দ্রনাথকে বই পাঠিয়েছেন মতামতের জন্য; ঠোঁট-কাটা সমর সেন, সবাইকে যিনি বিদ্রুপবাণে বিদ্ধ করেছেন, তিনিও রবীন্দ্রনাথকে চিঠিতে লেখেন, ‘আমার কবিতার বইয়ের এক কপি আপনার ঠিকানায় পাঠিয়েছি। আপনার কেমন লেগেছে জানতে পারলে বাধিত হবো।’ বাংলা উপন্যাসের দিকপাল তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে পর্যন্ত কবিগুরুর সুপারিশ যাচনা করতে হয়েছে। ব্যতিক্রম কেবল আমাদের মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। যাঁর পূর্বপুরুষের আদিনিবাস আমাদেরই বাংলার বিক্রমপুর। আত্ম-অহংবোধ, প্রতিবাদ ও স্বাজাত্য চেতনার বোধবুদ্ধি তিনি পেয়েছিলেন এই মাটি-জল থেকেই।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলতেন, অন্ধকারে যে বাস করে মৃদু আলোতে তাহার চোখ ঝলসাইয়া যায়। আমাদের কালে যুবামানুষেরা পাঠাভ্যাস ভুলে আধুনিকতার নামে ইলেক্ট্রিক গ্যাজেটে বুঁদ হয়ে কেবল অন্ধকারই হাতড়ে বেড়াচ্ছে যেন। এমন বাস্তবতায় মৃদু আলোতেও নিজেদের চোখ ঝলসে না দিয়ে এক অনিন্দ্য জীবনবোধে উদ্দীপ্ত হতে মানিক বন্দোপাধ্যায় রচিত পুতুলনাচের ইতিকথা, দিবারাত্রির কাব্য, পদ্মা নদীর মাঝি ইত্যাদি উপন্যাস বা অতসীমামী, প্রাগৈতিহাসিক, ছোটবকুলপুরের যাত্রী প্রভৃতি গল্পসম্ভারে আমরা কি একবার চোখ বুলিয়ে আসতে পারি? তবেই মানুষ হয়ে উঠবার মূল মন্ত্রণাটা হয়তো পেতে পারি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো ৮১ বছরের দীর্ঘ জীবন পাননি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর, মাত্র ৪৮ বছর বয়সে শক্তিশালী এই কথাসাহিত্যিকের জীবনাবসান ঘটে। ১৯০৮ সালের ১৯ মে এই মহান কথাশিল্পী মাতা নীরদাসুন্দরী দেবীর কোল আলো করেছিলেন। আমরা এই দিনে ব্যতিক্রমী এই কলম পেষা মজুর ও ব্রাত্য জীবনের অমর কথাকার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি। 


সূত্র : এনটিভি

No comments

Powered by Blogger.