রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের প্রথম সাক্ষাৎ : জহিরুল হক



রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের সাক্ষাতে অনেক কথা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে বলেছিলেন শান্তিনিকেতনে থেকে যেতে। সেখানে তিনি ছেলেমেয়েদের ড্রিল শেখাবেন আর দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে গান শিখবেন। নজরুল এ প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। নজরুলের উত্তরে রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন তিনি কোন পথের পথিক। নজরুলও সে প্রস্তাব গ্রহণ না করে ভালো করেছেন। তার জীবনে তা প্রমাণিত হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। দুজনই মৌলিক ও যুগপ্রবর্তক কবি। তারা আমাদের ঐশ্বর্য। বাঙালি তথা বিশ্বের মানুষের কাছে এ দুই কবি সমানভাবে শ্রদ্ধেয়। রবীন্দ্রনাথের লেখায় আমরা যে রেনেসাঁ প্রত্যক্ষ করেছি, তাতে নতুন ও সুন্দরের গড়ার ভার ছিল তার ওপরই। ঘুনে ধরা পুরনোকে ভাঙার দায়িত্ব পড়ল নজরুলের ওপর। বিশ্বজনীন প্রেমানুভূতি ও প্রজ্ঞা রবীন্দ্রনাথকে কঠোর ও নির্মম হতে দেয়নি। শিক্ষা-বিজ্ঞানীর মতো তার চেষ্টা ছিল পরোক্ষ। নজরুল প্রত্যক্ষ ফল লাভে উৎসুক ছিলেন। দুজনের লক্ষ্য ছিল এক এবং অভিন্ন_প্রেম পাওয়া ও দেয়া। সমাজ-ধর্ম-রাষ্ট্র থেকে অসুন্দর অপসারিত করে কল্যাণ ও সুন্দরের প্রতিষ্ঠাই ছিল তাদের লক্ষ্য। অপ্রেম অসুন্দরই নজরুলকে করেছে সংগ্রামী। বোধিপুষ্ট রবীন্দ্রনাথের ছিল সইবার ও অপেক্ষা করার ধৈর্য। জীর্ণ আবর্জনা সরিয়ে না ফেললে নতুন ইমারত গড়ে তোলা যে দুঃসাধ্য_এ বাস্তববোধ রবীন্দ্রনাথের ছিল। তা তিনি পারছিলেন না বলে অস্বস্তিবোধ করছিলেন। তা-ই করার ব্রত নিয়ে একজনের সদম্ভ আবির্ভাব দেখে রবীন্দ্রনাথ নিজে উল্লসিত হয়ে নজরুলকে অভিনন্দন না জানিয়ে পারেননি। রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে যে বিশেষভাবে স্নেহ ও ভালোবাসতেন তার প্রমাণ তিনি রেখে গেছেন। রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় আর নজরুলের কর্মে বাঙালির রেনেসাঁ পূর্ণতা লাভ করেছে। উভয়ে একে অন্যের পরিপূরক।
শৈশব থেকেই নজরুল রবীন্দ্রনাথকে খুবই শ্রদ্ধা করতেন। শৈশবে দরিরামপুর স্কুলে একটি বিচিত্রানুষ্ঠান হয়, সে-অনুষ্ঠানে নজরুল রবীন্দ্রনাথের 'পুরাতন ভৃত্য', ও 'দুই বিঘা জমি' কবিতা দুটো আবৃত্তি করে উপস্থিত সবাইকে মুগ্ধ করে দেন। নজরুল তার 'বড়র পিরিতি বালির বাঁধ' প্রবন্ধে বলেছেন, 'ছেলেবেলা থেকে তার (রবীন্দ্রনাথের) ছবি সামনে রেখে গন্ধ-ধূপ-ফুল-চন্দন দিয়ে সকাল-সন্ধ্যা বন্দনা করেছি।' এ উদ্ধৃতি থেকে বোঝা যায় নজরুল রবীন্দ্রনাথকে কতটা শ্রদ্ধা করতেন। পরে করাচিতে সৈনিক জীবনেও রবীন্দ্রনাথের গানের স্বরলিপি নজরুলের কাছে থাকত। সৈনিক জীবন শেষে কলকাতায় এসেও প্রথমে নজরুল গাইতেন রবীন্দ্রনাথের গান। বিভিন্ন সময়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে। বিভিন্ন সভা সমিতি ও স্মরণ সভায় তারা একসঙ্গে উপস্থিত থেকেছেন। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর আগে ও পরে নজরুল কয়েকটি কবিতা ও গান রচনা করেছেন। সেগুলো অত্যন্ত সুন্দর।

 পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় বর্ণিত সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত কথিত রবীন্দ্রনাথের উক্তিতে বলতে হয়, রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বুঝতে পেরেছিলেন, নজরুলের লেখা_ভাবের সংস্কৃতি সমন্বয়ের সাধনায় এ এক নতুন অবদান। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ঠিক কত তারিখে নজরুলের দেখা হয়, তা জানা যায়নি। তবে প্রভাত কুমারের 'রবীন্দ্রজীবনী' পৃষ্ঠা-৮৬ থেকে জানা যায়, ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১২ মে থেকে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাস পর্যন্ত প্রায় চৌদ্দ মাস রবীন্দ্রনাথ ইউরোপে ছিলেন। ইউরোপ থেকে ফিরে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জুলাই পর্যন্ত ইউরোপ-আমেরিকা সফর করেন। ১৬ জুলাই বোম্বাই থেকে বর্ধমান হয়ে বোলপুর আসেন। ২০ জুলাই ১৯২১ কলকাতা আসেন আত্মীয়-স্বজন-বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে দেখা করার জন্য। মাঝখানে একবার শান্তিনিকেতনে ফিরে গেলেও সেপ্টেম্বরের ৬ তারিখ পর্যন্ত তিনি কলকাতায় ছিলেন। ওই সময়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের প্রথম দেখা হওয়া সম্ভবপর। 
'জোড়াসাঁকোর বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসার সময় তেমন বড় লোককেও সমীহ করে যেতে দেখেছি,_অতি বাকপটুকেও ঢোক গিলে কথা বলতে শুনেছি_ কিন্তু নজরুলের প্রথম ঠাকুর বাড়িতে আবির্ভাব সে যেন ঝড়ের মতো। অনেকে বলত, তোর এসব দাপাদাপি চলবে না জোড়াসাঁকোর বাড়িতে, সাহসই হবে না তোর এমনিভাবে কথা কইতে। নজরুল প্রমাণ করে দিল, সে তা পারে। তাই একদিন সকাল বেলা_'দে গরুর গা ধুইয়ে,'_ এ রব তুলতে তুলতে সে কবির ঘরে গিয়ে উঠল_ কিন্তু তাকে জানতেন বলে কবি বিন্দুমাত্র অসন্তুষ্ট হলেন না।'
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের ইতোপূর্বে সাক্ষাৎ হয়নি। ছোটবেলা থেকে তিনি যেভাবে রবীন্দ্রনাথকে ভক্তি ও শ্রদ্ধা করতেন, তাতে সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় যেভাবে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের সাক্ষাতের কথা বলেছেন তা-ও অদ্ভুত বলে মনে হয়। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের কথা লিখতে গিয়ে তিনি বাড়িয়ে লিখছেন কিনা সে প্রশ্ন এসে যায়। কারণ যার সঙ্গে কখনো দেখা হয়নি, তার সঙ্গে নজরুল দেখা করতে গেলেও ওভাবে রব তুলতে তুলতে গেছেন বলে মনে হয় না।
জোড়াসাঁকোয় রবীন্দ্র-নজরুলের সাক্ষাতের ব্যাপারে একটি তথ্য পাওয়া গেলেও প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের কোন সময়ে, কোন স্থানে সাক্ষাৎ ঘটেছিল তার কোনো তথ্যভিত্তিক প্রমাণ আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে নজরুলের সৃষ্টিক্ষমতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ সজাগ ছিলেন। তার চিন্তাধারা ও কর্মজগৎ সম্পর্কেও তিনি খবর রাখতেন। শান্তিনিকেতনে নজরুল ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনে ছিলেন সুধাকান্ত রায়চৌধুরী। তিনি রবীন্দ্রনাথের একান্ত সচিব ছিলেন। নিজেও কবিতা লিখতেন এবং নজরুলের কবিতা পত্রপত্রিকা থেকে রবীন্দ্রনাথকে পড়ে শোনাতেন। 
প্রভাতকুমারের 'রবীন্দ্রজীবনী' তৃতীয় খ- পৃষ্ঠা-১২০ থেকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের সাক্ষাতের ব্যাপারে একটি তথ্য পাওয়া যায়। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের শরৎকালে পুজোর ছুটিতে নজরুলকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে গিয়েছিলেন ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্। সেবার দুর্গাপূজা ছিল ৮ অক্টোবর। কলকাতায় গান্ধীজির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে শান্তিনিকেতনে ফিরে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ৮ সেপ্টেম্বর থেকে ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন। তিনি ছিলেন শান্তিনিকেতনের প্রান্তরমধ্যস্থিত পর্ণকুটিরে। অনেকেই তখন তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তরুণ কবি নজরুলও তাদের মধ্যে একজন ছিলেন। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের সাক্ষাৎকারের স্মৃতিচারণ করেছেন রবীন্দ্রনাথের তখনকার একান্ত সচিব কবি সুধাকান্ত রায়চৌধুরীর ভাই নিশিকান্ত রায়চৌধুরী 'আমার কৈশোর স্মৃতিতে নজরুল' প্রবন্ধে। নিশিকান্ত রায় তখন শান্তিনিকেতনের বালক-ছাত্র। পুজোর ছুটি শেষ হয়ে গেছে। শান্তিনিকেতনের আশ্রমে ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রীরা সবাই এসে পড়েছে। রবীন্দ্রনাথও বাইরে থেকে ঘুরে এসেছেন। নিশিকান্ত সবে শিশুবিভাগ থেকে নতুন গুরুপল্লীতে দাদা সুধাকান্তের বাড়িতে এসেছেন। এমন সময় নিশিকান্তের দাদা সুধাকান্ত তার বন্ধু-বান্ধবদের বলছিলেন, হাবিলদার কবি কাজী নজরুল ইসলাম সন্ধ্যায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে আসবেন। নিশিকান্তের ভাই সুধাকান্তের ওপরই ভার পড়েছিল স্টেশন থেকে নজরুলকে নিয়ে আসার। কলাভবনের দোতলায় সান্ধ্য আসরে সুধাকান্তের সঙ্গে সচকিত মন নিয়ে নিশিকান্তও সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। সবার মাঝখানে রবীন্দ্রনাথ বসেছিলেন। শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রীরা সবাই উপস্থিত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের পাশে বসা দুজন আগন্তুকের একজনের দিকে অঙ্গুলি-নির্দেশ করে সুধাকান্ত নিশিকান্তকে বললেন, 'ওই দেখ কবি নজরুল ইসলাম।' সুধাকান্ত নিশিকান্তকে নজরুলকে দেখিয়ে দিলেন। এবং পরে তিনি নজরুলের পাশে গিয়ে বসলেন। 
নজরুল তখন রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে একটি গান ও একটি কবিতার আবৃত্তি শুনতে চেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথও নজরুলের গান ও আবৃত্তি শোনার প্রতীক্ষায় ছিলেন। তাই নজরুলকেই তাড়াতাড়ি গান গাইতে বললেন। নজরুল তখন একটা অন্তরস্পর্শী ভাব-ব্যঞ্জনা নিয়ে 'অগি্নবীণা'র 'আগমনী' কবিতাটি রবীন্দ্রনাথকে আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন। আবৃত্তির পরে রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে গান গাওয়ার জন্য আহ্বান করলেন। নজরুল পুত্র বিয়োগ-ব্যথাবিধুর কণ্ঠে বিষাদঘন করুণ সুরে গেয়ে উঠলেন, 
'কোন্ সুদূরের চেনা বাঁশির ডাক শুনেছিস্ ওরে চখা,
ওরে আমার পলাতকা!'
গানটি শুনে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, 'বাহ্ বেশ!। এটি কবে লিখলে?' তখন শহীদুল্লাহ্ সাহেব রবীন্দ্রনাথকে জানালেন, 'সমপ্রীতি কাজী সাহেব তার একটি শিশুপুত্রকে হারিয়ে এ শোকগাথাটি রচনা করে সান্ত্বনা খুঁঁজে ফিরছেন।' এ কথা শুনে রবীন্দ্রনাথ কিছুক্ষণ নীরব থেকে সমবেদনা প্রকাশ করলেন। নজরুল তখন রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠের একটি কবিতার আবৃত্তি ও একটি গান শুনতে চাইলে রবীন্দ্রনাথ সুললিত ও রমণীয় কণ্ঠে সমপ্রতি লেখা একটি গান কবিতায় আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন,
'মাধবী হঠাৎ কোথা হতে 
এলো ফাগুন দিনের স্রোতে
এসে হেসেই বলে, 'যাই যাই যাই।' 
রবীন্দ্রনাথ যতক্ষণ আবৃত্তি করছিলেন, ততক্ষণই নজরুলের কালো বাবরি চুলের মাথাটি তালে তালে দুলছিল। আবৃত্তি শেষ করেই রবীন্দ্রনাথ উঠে দাঁড়ালেন।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের সাক্ষাতে অনেক কথা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে বলেছিলেন শান্তিনিকেতনে থেকে যেতে। সেখানে তিনি ছেলেমেয়েদের ড্রিল শেখাবেন আর দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে গান শিখবেন। নজরুল এ প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। নজরুলের উত্তরে রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন তিনি কোন পথের পথিক। নজরুলও সে প্রস্তাব গ্রহণ না করে ভালো করেছেন। তার জীবনে তা প্রমাণিত হয়েছে। 
ওপরে আমরা জোড়াসাঁকো ও শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের দুটো সাক্ষাতের কথা উল্লেখ করেছি। জোড়াসাঁকোয় সাক্ষাৎকার যদি জুলাই-সেপ্টেম্বর ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের কোনো এক সময়ে হয় আর শান্তিনিকেতনের সাক্ষাৎকার তো অক্টোবরে হয়েছে বলে প্রভাতকুমার উল্লেখই করেছেন, তাহলে উভয় সাক্ষাৎকারের ব্যবধান বেশিদিনের নয়। এ ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলা সম্ভব নয়। আমাদের বিভিন্ন লেখকদের লেখার ওপর নির্ভর করতেই হচ্ছে। তবে আমাদের কাছে মনে হয়, যেহেতু দুই সাক্ষাৎকারের ব্যবধান বেশি নয়, তাই যে কোনো এক জায়গায়ই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথমে দেখা হয়েছিল।

জহিরুল হক: কবি, কথাসাহিত্যিক ও সহকারী অধ্যাপাক, বাংলা বিভাগ, ক্যামব্রিয়ান কলেজ

সূত্র : যায়যায়দিন

No comments

Powered by Blogger.