কবিতার দায় : শামসুর রাহমান



আজকাল ব্যান্ড-শোর দিকে বহুজনের তীব্র আকর্ষণ লক্ষ্য করা যায়। চড়া দামের টিকেট কিনে নরনারী, বিপুলসংখ্যক উঠতি বয়সের কিশোর-কিশোরী সেই অনুষ্ঠানে হাজির হয়। তুমুল উপভোগ করে। আমি এই আকর্ষণকে বাঁকা চোখে দেখি না। কিন্তু কোনও কবি সম্মেলনে বিনা টিকেটেও এরকম ভিড়ের চল্লিশ ভাগের এক ভাগও দেখা যায় না। কারণ একটাই, কবিতা পাঠ কিংবা শোনার প্রতি অধিকাংশ মানুষেরই তেমন উৎসাহ নেই। এর কারণ যদি খুঁজতে যাই তাহলে প্রথমেই কেউ কেউ বলবেন, শিক্ষার দুর্ভিক্ষই এজন্যে দায়ী। এটি একটি কারণ বটে, কিন্তু একমাত্র কারণ নয়। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আমাদের সমাজে এমন অনেক শিক্ষিত ব্যক্তি আছেন যারা কবিতার প্রতি কোনও আগ্রহ বোধ করেন না। পক্ষান্তরে কোনও কোনও অল্প শিক্ষিত ব্যক্তিও কবিতা ভালোবাসেন, সীমিত গাঁটের পয়সা খরচ করে কবিতার বই কেনেন, মন দিয়ে পড়েন এবং কবিসম্মেলনে নিয়মিত হাজির থাকেন। কিছু একনিষ্ঠ কবি-পাঠক, যারা নিজেরা কবিতা লেখেন না, আমাদের সমাজে দুর্লভ নয়। সন্দেহ নেই, বিস্তৃত কালো মেঘের এটি এক চিলতে শুভ আলো।


সত্যি বলতে কি, কেন আমি কবিতা লিখতে শুরু করেছিলাম এক মেঘলা দুপুরে, জানি না। আজও ঠিক বলতে পারবো না, কেন আমি জীবনের গোধূলিতেও কবিতার পঙ্‌ক্তিমালা রচনা করি। অনেক বছর আগে লিখেছিলাম-

যদি বাঁচি চার দশকের বেশি

লিখবো।

যদি বেঁচে যাই একটি দশক

লিখবো।

যদি বেঁচে যাই দু’চার বছর

লিখবো।

যদি বেঁচে যাই একটি বছর

লিখবো।

যদি বেঁচে যাই এক মাস কাল

লিখবো।

যদি বেঁচে যাই একদিন আরো

লিখবো।


আমার এই উচ্চাশা কার উদ্দেশে? এই কথাগুলি বলছি আমার খাতার সাদা পাতাকে, কলমকে, আমার মনকে। অর্থাৎ আমি নিজেরই উদ্দেশে করছি এই উচ্চারণ, আমার এই সংকল্প। যেন আমি দায়বদ্ধ আমার নিজেরই কাছে। এই দায়, সত্যি বলতে কি, আমার ওপর কেউ চাপিয়ে দেয়নি। আগেই বলেছি, কেন আমি লিখতে শুরু করেছিলাম, জানি না। কেউ তো আমার সঙ্গে কোনও রকম জোরজবরদস্তি করেনি, এই লেখার কাজটি চাপিয়ে দেয়নি আমার ওপর। এক অকারণ আবেগেই তো খাতার শূন্য পাতায় কবিতার প্রথম পঙ্‌ক্তিটি লিখে কাব্যজীবনের সূচনা করেছিলাম। সেদিন ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি তেপ্পান্ন বছর ধরে আমাকে যেতে হবে। আমার অজ্ঞাতেই এক ধরনের দায় আমাকে দখল করে ফেলল ক্রমান্বয়ে। কবিতা লেখার দায়। বলা হচ্ছে কবিতার দায়ের কথা। কবিতা নিজে নিজেই তো লিখিত হয় না। একজন ব্যক্তি, যিনি কবি, কবিতা লিখে থাকেন। তিনি অভিজ্ঞতা, কল্পনা, মেধা ও মননের সহযোগিতায় কবিতা রচনা করেন কবিতার দায় মানেই কবির দায়।


নীরব কবি বলে কোনও কিছু নেই পৃথিবীতে। যিনি যে দেশের কবি সেই দেশের ভাষাতে, মানে তার মাতৃভাষার কবিতা রচনা করেন। কেউ কেউ বিদেশী ভাষাতেও কবিতা রচনা করে থাকেন। যে ভাষাতেই লিখিত হোক সেই রচনাকে কবিতা হতে হবে। হতে হবে প্রকৃত কবিতা। কবিতা কী, এই প্রশ্ন মনে জাগা খুবই স্বাভাবিক। কাকে কবিতা বলবো, এই প্রশ্নের জবাব নানা মুখি নানাভাবে দিতে চেষ্টা করেছেন। সেসব সংজ্ঞার ফিরিস্তি পেশ না করে কবি তার অভিজ্ঞতা অন্তরের পাতায় সহজভাবে বলা যেতে পারে, একজন খাঁটি কবি তার অভিজ্ঞতা-সচ্ছতা অন্তরের নির্যাসটুকু শিল্পিতরূপে কলমের ডগা থেকে কাগজের শূন্য পাতায় লিপিবদ্ধ করলেই কবিতা হয়ে ওঠে। কবিতার বিষয়বস্তুর কোনও সীমা-পরিসীমা নেই। আণবিক বোমার ভয়াবহতা থেকে শুরু করে ঘাস পর্যন্ত যে কোনও বিষয় নিয়েই কবিতা লেখা যেতে পারে। যুদ্ধ, শান্তি, প্রেম, হিংসা, ঈর্ষা, ক্রোধ, পথ-চলতি মুটে, পরী, ভিখিরি, ধনকুবের- কোনও কিছুই কবিতার বিষয়ের আওতার বাইরে নয়। বাস্তবের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, সংগ্রামী ছাত্র, সন্ত্রাসী, কল্পনাজগতের পরী- কাউকেই কবিতার আওতার বাইরে রাখা চলে না। যে কবি যেমন ইচ্ছা লিখতে পারেন। শুধু লক্ষ রাখতে হবে, সেটি যেন কোনওক্রমেই অ-কবিতা না হয়। লেখায় নান্দনিক আভা অবশ্যই থাকতে হবে। সহজেই লেখাটিকে শিল্পোত্তীর্ণ বলে গ্রাহ্য করবে সমঝদার পাঠক-পাঠিকা। ঘাস ধরতে গেলে খুবই সামান্য বস্তু। কিন্তু জীবনানন্দ দাশের কাব্যগুণে সেই সামান্য বস্তুটি কেমন অসামান্য হয়ে উঠেছে-

কচি লেবুপাতার মতো নরম সবুজ আলোয়

পৃথিবী ভরে গিয়েছে এই ভোরের বেলা,

কাঁচা বাতাবির মতো সবুজ ঘাস- তেমনি সুঘ্রাণ-

হরিণেরা দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে নিচ্ছে।

আমার ইচ্ছা করে এই ঘাসের এই ঘ্রাণ হরিৎ মদের মতো

গেলাসে গেলাসে পান করি,

এই ঘাসের শরীর ছানি- চোখে ঘষি,

ঘাসের পাখনায় আমার পালক,

ঘাসের ভিতর ঘাস হয়ে জন্মাই কোনো এক নিবিড় ঘাস-মাতার

শরীরের সুস্বাদ অন্ধকার থেকে নেমে।


তাহলে আমরা বলতে পারি, শুধু বিষয়বস্তুর জন্য কোনও ছন্দোবদ্ধ রচনা কবিতার মর্যাদা পায় না। জীবনানন্দ দাশের কবিতাটি গদ্য ছন্দে রচিত, কোনও পদ্যছন্দে নয়। এতদসত্ত্বেও রচনাটি একটি খাঁটি কবিতা। কয়েকটি পঙ্‌ক্তিতে কবি তাঁর অন্তর্গত বোধ এবং নান্দনিক চেতনার স্বাক্ষর রেখেছেন সুপ্রযুক্ত শব্দাবলীর মাধ্যমে, সেই শুনেই ঘাস একটি সার্থক কবিতা হয়ে উঠতে পেরেছে। এখানে গদ্য কবিতা হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি, বরং আমরা বিশ্বাস করতে বাধ্য হই যে, পদ্যছন্দে কবিতার এই রূপটি পরিস্ফুট হতো না। কখনও সখনও কবির দায় নিয়ে শোরগোল হয়, লক্ষ করেছি। মাঝে মাঝে কবিদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে প্রচুর নসিহতও করে থাকেন কেউ কেউ। একজন কবি এ ধরনের কবিতা কেন লেখেন, কেন তাদের প্রেসক্রিপশন অনুসারে লেখেন না- এমন গরম হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়। কিন্তু একজনও প্রকৃত কবির পক্ষে কারও নির্দেশ মেনে নিয়ে কবিতা লেখা সম্ভব নয়। তিনি তার কাব্যক্ষমতার সর্বনাশ করতে সক্ষম। বরং তিনি লেখা বন্ধ করে দেবেন, কিন্তু কোনও দল কিংবা ব্যক্তির নির্দেশ মেনে নিতে পারেন না। কী করে তিনি কাব্যলক্ষ্মীর অমর্যাদা করবেন?


কবি দায়বদ্ধ কবিতার কাছে। সমাজের প্রতি কবির দায়বদ্ধতার প্রশ্ন হরহামেশা ওঠে। যেহেতু কবিও সমাজের একজন সদস্য, তাই এই প্রশ্ন উঠতেই পারে। এতে আপত্তি করার কিছু নেই। আমি মনে করি, একজন কবি ভালো কবিতা লিখতে পারলে, তার দেশের কবিতাকে সমৃদ্ধ করতে পারলেই তিনি দায়বদ্ধতার পরিচয় দেন। যদি তিনি জনসভা কিংবা মিছিলে যোগ দিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে শ্লোগান দেন, তাহলে সেটা হবে তার অন্য প্রকার নাগরিক হিসেবে অতিরিক্ত দায়ীত্ব পালন।

আমার বলার উদ্দেশ্য এ নয় যে, কবি গজদন্তমিনারবাসী হয়ে সাদা কাগজে আকাশ কুসুম সৃষ্টি করবেন। তিনি যেমন প্রেমের কবিতা লিখতে পারেন, গাছগাছালি, ফুল, পাখি, মাঠ, নদী ইত্যাদি নিয়ে লিখতে পারেন, তেমনি অনাচার, স্বৈরাচার ইত্যাদি বিষয়ে লেখারও অধিকার আছে তার। কিন্তু শর্ত একটাই। সেই রচনাকে অবশ্যই কবিতা পদবাচ্য হতে হবে। এবং তাগিদে লিখতে রাইনার মারিয়া রিলকের ‘পদারুলী’ যেমন কালজয়ী কবিতা, পল এলুয়ারের কবিতাও তেমনি, যদিও দুজনের কবিতার বিষয় আলাদা, প্রকাশভঙ্গী স্বতন্ত্র। রিলকে মানুষের আস্থার গহনের ডুবুরি, এলুয়ার প্রেম বিষয়ক সাধারণ পঙ্‌ক্তিমালার স্রষ্টা বটে, কিন্তু জনগণের সংগ্রামেরও রূপকার। কিন্তু তাঁর কবিতা শ্লোগান নয়। আমরা উভয়ের কবিতা পড়তে ভালোবাসি।

সত্যিকারের উঁচু দরের কবিতার কদর হাট-বাজারের উত্তাল ভিড়ে হবে বসে মনে হয় না। রবীন্দ্রনাথ কিংবা জীবনানন্দ দাশের কবিতা কি হাট-বাজারে বিকোবে? মনে হয় না। ব্যতিক্রমও রয়েছে, যেমন লালন ফকির। লালন শুধু উঁচু দরের সাধকই নন, বড় মাপের কবিও, যাঁর কদর স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও করতেন। তবে এরকম উদাহরণ অত্যন্ত বিরল হোক, হাটবাজারে বিকোয় না বলে কবিগণ কি সবসময় কলম ক্যাপবন্দী করে রাখবেন? কবিতাকে জলাঞ্জলি দেবেন শূন্যতায়? না, প্রকৃত কবি কারও মুখাপেক্ষী হয়ে কবিতা রচনা করেন না। তিনি না লিখে থাকতে পারেন না বলেই একটি ছোট কবিতা লেখার জন্য কয়েকটি বিনিদ্র রাত কাটিয়ে দেন। তাই না বলে পারছি না, কবির যেমন দায়বদ্ধতা রয়েছে পাঠক এবং সমাজের প্রতি, অনুরূপভাবে পাঠকশ্রেণী এবং সমাজেরও একটা দায়িত্ব আছে কবির প্রতি। কিন্তু লেখার সময় কবি কবিতা ছাড়া অন্য কোনও ভাবনা আমল দেন না, পঙ্‌ক্তিমালা রচনা করে যান মনের তাগিদে।


আমাদের ব্যবহারিক জীবনে লেনদেন বলে একটি কথা প্রচলিত আছে। এই দেয়া-নেয়া ব্যাপারটি কবি, কবিতাপাঠক এবং গোটা সমাজের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। পাঠক-পাঠিকাগণ যদি কবিতার বই না কেনেন, সমাজ যদি কবির প্রতি চরম উদাসীন থাকে তাহলে কবির পক্ষে সংসারে টিকে থাকাই মুশকিল। একজন সত্যিকারের ভালো কবির বইও তেমন বেশি বিক্রি হয় না। অনেকে সস্তা উপন্যাস, রগরগে কাহিনীসম্বলিত কেতাবের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েন, অথচ কবিতার বই ছুঁয়েও দেখেন না। হেলাভরে ছুঁয়ে দেখলেও সহজে কেনার কথা ভাবেন না।

একজন কবি তো বায়ুভুক নন, এবং সকল কবিই একেবারে একা অর্থাৎ স্ত্রী-পুত্র-কন্যাহীন জীবন যাপন করেন না। তাই জীবনের যত অর্থেরই সন্ধান করুন না কেন অর্থ অর্থাৎ বেশ কিছু টাকাকড়িরও প্রয়োজন হয় তার। সমাজের পক্ষ থেকে যদি সহযোগিতার হাত এগিয়ে না আসে তাহলে কবির ভোগান্তির সীমা থাকে না। বহু বছর আগেকার একটি অত্যন্ত মর্মান্তিক ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। ব্রিটিশ আমলের কথা। আমাদের সমাজে বসবাসকারী একজন কবি ছিলেন। ‘কঙ্কাল’ নামে একটি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা তিনি। কলকাতায় থাকতেন। অর্থাভাবের পীড়নে এমনই পর্যুদস্তু ছিলেন আমাদের সেই কবি অর্থাৎ আশরাফ আলী খান যে দুতিন দিন অনাহারে কাটাবার পর ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন। কবিতা এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ সেই কবিকে রক্ষা করার উদ্যোগ নেয়নি উদাসীন সমাজ।


একজন মর্যাদাসম্পন্ন কবি বিশেষ কোনও দল, সংগঠন কিংবা প্রতিষ্ঠানের রীতিনীতি পছন্দ করতে পারেন, কিন্তু তা বলে সেই দল কিংবা প্রতিষ্ঠানের কাছে নিজেকে বিকিয়ে দিতে পারেন না। তার পছন্দের সংস্থার কোনও কাজ পছন্দ না হলে তিনি সেকাজের বিরোধিতা করার অধিকার রক্ষা করবেন সবসময়। প্রয়োজনবোধে সেখান থেকে সরে দাঁড়াতেও কুণ্ঠিত হবেন না। মত প্রকাশের স্বাধীনতা বজায় তাকে রাখতেই হবে। নইলে অনিবার্য তার স্খলন। কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর একটি কবিতায় বহুকাল আগেই লিখে গেছেন, ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়?’ না, স্বাধীনতাহীনতা কোনও মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিরই কাম্য নয়, কবি শিল্পীর তো নয়ই।

আগেই বলেছি, আবারও বলছি, কবি তার কাব্যলক্ষ্মীর প্রতি দায়বদ্ধ। কোনও বিশেষ প্রতাপশালী ব্যক্তি কিংবা দলকে তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে প্রকৃত কবি তার কলমকে খাটাতে পারেন না। খাটালে তিনি ভ্রষ্ট হবেন তার কাব্যাদর্শ থেকে। পরিণামে তিনি নিজেকে তো খাটো করবেনই নিজের এবং তার অনুরক্ত ভক্তদের কাছে আস্থা হারাবেন। সৎ কবিতার শর্তাবলী মেনে নিয়েই কবিকে আপন সত্তার গহনে বারবার ডুব দিয়ে তুলে আনতে হয় কবিতারূপী খাঁটি মুক্তো। নইলে কবিতার প্রতি তার যে দায় তা মেটাতে তিনি ব্যর্থ হবেন।

No comments

Powered by Blogger.