শালিক-টুনটুনি : মোশারফ হোসেন মুন্না


ছোট্ট একটা শালিক পাখি। সবে মাত্র উড়তে শিখেছে। বাবাহীন ভুবনে মা-ই তার একমাত্র ভরসা। তার বাবা কীভাবে মারা গেছে সে সম্পর্কে তার মা তাকে কোনোদিন কিছু বলেনি। যা হোক, খুব সুখে শান্তিতে যাচ্ছিল তাদের দিনগুলো। ছোট্ট পাখিটি ধীরে ধীরে বড় হচ্ছিল।

একদিন ঘোর বিপত্তি ঘটল। ছোট্ট পাখিটি খুব অসুস্থ হয়ে পড়ল। এমতাবস্থায় তার মা খাবার সংগ্রহ করতে গেল। দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। কিন্তু তার মায়ের ফিরে আসার কোনো নাম নেই। এদিকে সেও দুর্বল থাকার কারণে উড়তে পারছে না।

কিছুক্ষণ পর কয়েকটি শালিক এসে জানাল, তার মাকে কিছু লোভী মাংসাসী মানুষ ধরে নিয়ে গেছে। তখন ছোট্ট পাখিটি বলে- এখন কী হবে? ওরা কী আমাকে মাকে খেয়ে ফেলবে?

এই বলে কান্নায় ভেঙে পড়ল সে।

প্রতিবেশী শালিকগুলো তাকে সান্ত¡না দিতে লাগল। বলল- কিছু হবে না, আমরা আছি তো। ভোর হোক, কিছু একটা করা যাবে।

এই বলে প্রতিবেশীরা তাকে কিছু পোকামাকড় দিল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে খেল। কারণ, তাকে সবল হতে হবে। তার মাকে খুঁজতে হবে। মা ছাড়া তার কে বা আছে।

রাত গড়িয়ে সকাল হলো। প্রতিবেশী শালিকগুলো যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ছোট্ট পাখিটি সব জড়তা, অসুস্থতাকে পেছনে ঠেলে উড়ার চেষ্টায় ব্রতী হলো। অনেক কষ্টে সে পাশের গাছের বুলুদের বাসায় গেল। বুলু বলল :

-আমরা বাপু দেখেছি গ্রামের দিকে নিয়ে গেছে। কিন্তু কোন বাড়িতে নিয়েছে সে তো জানিনে, তবে ওদিকে গ্রামের মাঝে একটা টুনটুনি থাকে, সে হয়তো জানতে পারে।

এতে ছোট্ট পাখিটি উৎসাহী হয়ে বুলুকে বলল- চলো না গো, আমরা এক সঙ্গে যাই।

বুলু- না বাপু, আমি যেতে পারব না। আমার ডিমে ‘তা’ দিবে কে শুনি?

অসহায় পাখিটি এদিক ওদিক ছুটে, একে ওকে জিজ্ঞেস করে শেষ পর্যন্ত টুনটুনির বাসায় গেল। কিন্তু টুনটুনি তাকে খুব করে তাড়িয়ে দিল। তথাপি, ছোট্ট পাখিটি হাল ছাড়ল না। বার বার তাড়া খেয়েও সে টুনটুনির বাসার কাছে যেতে লাগল। শেষ পর্যন্ত টুনটুনি পাখিটি হাল ছেড়ে দিয়ে তাকে তার বাসায় ডাকল। কী কারণে তার আসা টুনটুনিটি সেটা জিজ্ঞেস করল। ছোট্ট পাখিটি সব খুলে বলল।

টুনটুনিটির মনে বেশ মায়া হলো। কারণ তারও মা-বাবা নেই।

খুব ছোটবেলায় মানুষগুলো তার মা-বাবাকে ধরে নিয়েছে। তারপর তার মা-বাবা আর কোনোদিন ফেরেনি।

যা হোক, টুনটুনিটি বলল- চলো দেখি। তোমার মায়ের খোঁজ পাওয়া যায় কিনা।

এই বলে দুজনে ছুটল গ্রামের বিভিন্ন বাড়ির দিকে। নাহ্, অনেক খোঁজাখুঁজির পরও পাওয়া গেল না। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে এলো। বাসায় ফেরার সময়। ছোট্ট পাখিটি ফিরতে চাইল না। তার চোখ দিয়ে অনবরত জল পড়তে লাগল।

টুনটুনিটি বলল- কালকে আবার খুঁজব এখন চল। না হলে আবার বাসা খুঁজে পাওয়া যাবে না। ছোট্ট পাখিটি শেষমেষ টুনটুনির বাসার দিকে রওনা হলো। যেতে যেতে হঠাৎ একটা আওয়াজ শুনতে পেল ছোট্ট পাখিটি। হ্যাঁ, এ তো তার মায়ের কণ্ঠ।

আওয়াজ শুনে সে দিল ভো দৌড়। সঙ্গে টুনটুনি। একটা দালানের দিকে এগিয়ে এসে দেখল কতগুলো ছেলে উঠানে এসে কি যেন কাটাকুটি করছে। পাশে পা এবং ডানা বাঁধা অবস্থায়, তার মা। কিছুক্ষণ পরে চড়–ইভাতির জন্য মা শালিকটিকে জবাই করা হবে। মানুষগুলোর কথাবার্তায় এমনটি বুঝতে পারল টুনটুনিটি। সে বলল :

-শোন, আমি ওদের পাশ দিয়ে অসুস্থের অভিনয় করে যাব। ফলে সবাই আমাকে ধরার জন্য ছুটবে। অন্যদিকে তুমি তোমার মাকে নিয়ে পালাবে।

ছোট্ট পাখি- হ্যাঁ, ঠিক আছে। কিন্তু যদি তোমার কিছু হয়। টুনটুনি- কিছু হবে না। ওরা ধরতে আসলে, আমি উড়াল দিব।

যথা আজ্ঞা, তথা কাজ। টুনটুনিটি অসুখের অভিনয় করে, ডাক দিতে দিতে হেঁটে যেতে লাগল।

গ্রামের ছেলেমেয়েগুলো আরেকটি পাখি খাওয়ার লোভে টুনটুনির দিকে হামলে পড়ল। কিন্তু টুনটুনিটি এদিক-ওদিক ছুটে অন্য বাড়ির দিকে যেতে লাগল। ছেলেমেয়েগুলোও তার পিছু পিছু।

ওদিকে ছোট্ট পাখিটি তার মাকে নিয়ে পালালো। কিছুক্ষণ পর টুনটুনিটিও তাদের সঙ্গে যোগ দিল। অন্যদিকে ছেলেমেয়েগুলো সব হারাল। তাদের চড়–ইভাতি ভেস্তে গেল।

যা হোক, ছোট্ট পাখিটি এবং তার মা উভয়ই টুনটুনিটির বাসায় আশ্রয় নিল। মা শালিকটির পায়ে ব্যথা। দুদিন বেশ সেবা-যতœ হলো। মা শালিকটি সুস্থ হয়ে উঠল। ছোট্ট পাখিটি ও টুনটুনিটি বেশ খুশি হলো। কিন্তু এ সুখও তাদের কপালে বেশিদিন সইল না।

গ্রামের ছেলেমেয়েগুলো তাদের পিছু নিতে নিতে বাসার খোঁজ পেয়ে গেলো।

সেদিন ছোট্ট পাখিটি খাবার সংগ্রহে জঙ্গলের দিকে গিয়েছিল। বাসায় টুনটুনি ও মা শালিক। ওদিকে গ্রামের ছেলেমেয়েগুলো ক্ষোভে জিদে নির্বিচারে টুনটুনির বাসার দিকে ইট ছুড়তে লাগলো। দুজনের একজনও বাঁচল না। টুনটুনি ও মা শালিক দুজনের মাথা থেতলে গেল।

গ্রামের ছেলেমেয়েগুলো খুব খুশি হলো, দুটো পাখি পেল চড়–ইভাতির জন্য। এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতো। সন্ধ্যায় যখন ছোট্ট পাখিটি বাসায় ফিরল, দেখল সব শেষ। টুনটুনির বাসাটি ছিন্ন ভিন্ন। এদিক-ওদিক রক্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। হতভাগার আর বুঝতে বাকি রইল না। পাগলের মতো দিক-বিদিক ছুটতে লাগল।

মা মা করে চিৎকার দিতে দিতে এক ঝটকায় নিচের দিকে পড়ে গেল।

তার মাথা থেকেও রক্ত ঝরছে। একটা ছোট্ট ইট অবশিষ্ট কাজটাও সম্পন্ন করে দিল। গ্রামের ছেলেমেয়েগুলো হাততালি দিতে লাগল।

অন্যদিকে ছোট্ট পাখিটির চোখের সামনে থেকে সব আলো ধীরে ধীরে নিভে যেতে লাগল। এক সময় সব অন্ধকার হয়ে গেল।

*সমাপ্ত*

No comments

Powered by Blogger.